বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুদিবস ও বাংলাদেশের শিশু অধিকার

by - March 16, 2018


যদি রাত পোহালে শোনা যেতো,

বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

এই আক্ষেপ যেই মহান মানুষের জন্য, আজ তার জন্মদিন।

১৭ মার্চ, ১৯২০। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ফজিলাতুন্নেসার ঘর আলো করে আসে একটি শিশু। কিন্তু কে জানতো, সেই শিশুটিই হবে একটি জাতির জনক। জন্ম দিবে একটি স্বাধীন দেশের। যার জন্মের পর থেকেই শুরু হবে এক নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাস গড়া শিশুটির আজ জন্মদিন।

পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। তিনজন পুত্রই বঙ্গবন্ধু সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে আততায়ীর হাতে নিহত হন।

কখনো কখনো একটা মানুষ কোটি মানুষের ছায়া
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর তেমনই একটা মায়া।

বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একবৃন্তে তিনটি চেতনার ফুল। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু চির অম্লান, চিরঞ্জিব। তদ্রুপ বাংলার শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-মেহনতি জনতার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরভাস্বর। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জননেতা, একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক। সাধারণের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে সব সময় দাঁড়াতেন শেখ মুজিব। ছোটবেলায় তাঁকে বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাঁর বাবা একটা ছাতা কিনে দিয়েছিলেন। মুজিব সেই ছাতাটি তাঁর এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন, যার কোনো ছাতা ছিল না। আবার শীতকালে তাঁকে একটা চাদর দেয়া হয়েছিল। সেই চাদরটি তিনি এক অসহায় বৃদ্ধাকে দিয়েছিলেন। ক্ষুধায় কাতর দরিদ্র কৃষকদের নিজের ঘরের গোলার ধান বিলিয়ে দিতেও তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় সিক্ত করে তুলত।

যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’

তিনি সাধারণ মানুষের আশাকে ভাষা দিতে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন এবং বছরের পর বছর যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো কাটিয়েছেন নির্জন কারাবাসে। মানুষের জন্য হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চকে বেছে নিতে কখনো কুণ্ঠিত হননি। ঘাতকের বুলেট বুক পেতে নিয়েছেন কিন্তু জনগণের সঙ্গে বেইমানি করেননি বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছেন। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে মাথানত করেননি।

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মধ্যে দাঁড়ালেন।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর জন্মদিনটি শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। অপরদিকে একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এ দিনটি কেন জাতীয় শিশু দিবস হলো? কেন এ দিনটিকে শুধু শিশুদের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? কারণ বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। শিশুদের আনন্দ ও হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরই।

‘দিকে দিকে আজ অশ্রম্নুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।’

সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, সব সময়ই তিনি তা আশা করতেন। শৈশব থেকেই তাঁর বড় হৃদয় ও ছোট-বড় সবার জন্য দরদি হওয়ার কারণই মানুষকে তিনি অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে, সচেতন করতে, সংগ্রামী করতে পেরেছেন। রাজনীতির কাজে কিংবা দেশের বিভিন্ন কাজে যখন গ্রামেগঞ্জে যেতেন তখন চলার পথে শিশুদের দেখলে তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, খোঁজ-খবর নিতেন। দুস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে তাদের কাছে টানতেন। কখনো কখনো নিজের গাড়িতে উঠিয়ে অফিসে কিংবা বাড়িতে নিয়ে শিশুদের কাপড়চোপড়সহ অনেক উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

এই একটি লাইনই পরই নতুনভাবে হাসি ফুটেছিলো ৭ কোটি বাঙ্গালির মুখে।

বাংলাদেশে শিশু দিবস ও শিশুর অধিকারঃ

শিশু দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় পালিত হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাপী শিশুদের সম্মান করতে। শিশু দিবসটি প্রথমবার তুরস্কে পালিত হয়েছিল সাল ১৯২০র এপ্রিল ২৩তারিখে। বিশ্ব শিশু দিবস নভেম্বর ২০শে উদযাপন করা হয়, এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস জুন ১ তারিখে উদযাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশে নিজেস্ব নির্দিষ্ট দিন আছে শিশু দিবসটিকে উদযাপন করার।

১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয় বাংলাদেশে

আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের দেশশাসক। কবি। সাহিত্যিক। বিজ্ঞানী। বুদ্ধিজীবী। কলামলেখক। সাংবাদিক। সম্পাদক। আইনজীবী। সমাজসেবক।

এই ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের চোখে-মুখে যদি আমরা আলোর রেণু এঁকে দিতে চাই, তাহলে সবার আগে তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল পরিবেশে। আর আমরা যদি তাদের সেই শিশুবান্ধব পরিবেশ উপহার দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা যত স্বপ্নই তাদের ঘিরে দেখি না কেন, সব বরবাদ হয়ে যাবে, যা আমরা অবশ্যই কখনো চাইব না।


একটি শিশুর চোখে সব সময় সকল রকম সম্ভাবনার বারুদ ফিনকি দেয়। সেই বারুদে কেবল আগুন ঢেলে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের মেধা ও মননকে সঠিক জায়গায় নিয়ে লালন-পালন করতে পারে।


মানুষের মৌলিক অধিকার- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই ৫টি বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা যা চাই তা পাওয়াটা বোধ করি খুব কঠিন হবে না।


এক দলা কাদামাটি আর একটা শিশুতে আসলে মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই। নরম কাদামাটিতে যেমন ইচ্ছেমতো একজন কারিগর যা ইচ্ছে তাই বানাতে পারেন, ঠিক একইভাবে একটি শিশুকে একই প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।


একজন সাধারণ মানুষের মতোই একটি শিশুর অধিকার সমান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সবার আগে শিশুর জন্য ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। বিষয়টি খুবই চমৎকার। কিন্তু সেটি আমাদের পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ‘হ্যাঁ’ বলার প্রক্রিয়া আমাদের পরিবারের সীমারেখা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার মানে কেবল আমাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর বাইরেও অনেক শিশু রয়েছে, যারা দীনহীনভাবে বসবাস করে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নই যেখানে ঠিকমতো তাদের জোটে না। সেখানে অন্যান্য চাহিদার কথা তো সুদূর পরাহত। এ জন্য কেবল আমাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্যই নয়, এই বিষয়টি ‘এক বিশ্ব এক শিশু’ হিসেবে যেদিন আমরা ভাবতে শিখতে পারবো, সেদিনই আমাদের সমাজে শিশুর সকল মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।

১৯৮৯ সালের ২০ শে নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ। ইংরেজিতে একে সংক্ষেপে C R C (Convention on the Right of the Child) বলা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অন্যতম। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ এই সনদের প্রতি পুনরায় সমর্থন জানায়। ১০৫টি দেশ সনদটিতে স্বাক্ষরের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ গৃহীত ‘শিশু অধিকার সনদ’ সমগ্র বিশ্বের শিশুদের জন্য সর্বমোট ৫৪টি ধারা সংবলিত অধিকারকে স্বীকার ও সংরক্ষণের জন্য আইনগত ভিত্তি তৈরি করে।


একটি সমাজে পরিবার যেহেতু প্রাথমিক সংগঠন এবং এর সকল সদস্য বিশেষ করে শিশুদের বিকাশ ও কল্যাণের স্বাভাবিক পরিবেশ, সে কারণে তাকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা এবং সহায়তা দিতে হবে। যাতে সে সেখানে তার দায়িত্বসমূহ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাপারে আস্থাশীল হয়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ ও সুষম বিকাশের স্বার্থে আনন্দ, ভালোবাসা ও সমঝোতাপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে। আর সমাজে স্বকীয় জীবনযাপনের জন্য শিশুকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে তুলতে হবে এবং জাতিসংঘ ঘোষণায় বর্ণিত আদর্শসমূহের আলোকে বিশেষভাবে শান্তি, মর্যাদা, সহনশীলতা, স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির চেতনায় তাকে গড়তে হবে।
মোটামুটি কথা হচ্ছে- এই সনদের শরিক রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের বেঁচে থাকা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সর্বাধিক নিশ্চয়তা দেবে। জন্মের পরপরই শিশুর নিবন্ধীকরণ করতে হবে। জন্ম থেকেই তার নামকরণ লাভের, একটি জাতীয়তা অর্জনের এবং যতটা সম্ভব পিতামাতার পরিচয় জানার ও তাদের হাতে প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার থাকতে হবে- এ সকল বিষয়ই হচ্ছে শিশুর অধিকারসমূহের খসড়া। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে সকল অধিকারের প্রাপ্যতা তাদের রয়েছে তা আমাদের সমাজে কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে। হয়তো হচ্ছে তা ঘরোয়া পরিবেশে। নিজ নিজ সন্তানের বেলায়। কিন্তু যখনই সে সন্তান ওই একই ঘরোয়া পরিবেশে কাজের ছেলে বা মেয়ে হয়ে অবস্থান করে, তখন তা কিভাবে লঙ্ঘিত হয় সে বিষয় আমরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় প্রায়ই দেখতে পাই। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর হাতে সামান্য অপরাধে নির্যাতিত-নিষ্পিষ্ট হতে দেখে আমাদের মনে ঘৃণার উদ্রেক করে। এমনকি গৃহকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। টুকরো টুকরো এ সমস্ত ঘটনাই প্রমাণ করে এই অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজ আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। সমাজের অভ্যন্তরে তারা নিরাপদে অবস্থান করতে পারে এমন অনুকূল পরিবেশ আমরা গড়তে পারিনি।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এই সমাজে শিশুশ্রমের ব্যাপক বাজার রয়েছে। শিশুদের সহজে ঠকানো যায়, চোখ রাঙানি দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেয়া যায় বলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োগের ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত হতে দেখা যায়। এটা যে কতটা গর্হিত কাজ তা সচেতন মানুষ মাত্রেই বুঝবেন। এই মানসিকতা আমাদের যতদিন না বদলাবে ততদিন শিশু অধিকারের সকল বিষয়ই সূক্ষ্মভাবে লঙ্ঘিত হতে থাকবে।


শিশুশ্রমের ব্যাপারে বলা হচ্ছে- ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের বেতন, মুনাফা বা বিনাবেতনে কোনো পারিবারিক খামার, উদ্যোগ বা সংস্থায় কাজের জন্য নিয়োগ করা শিশুশ্রমের আওতায় পড়বে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে বেশির ভাগ পরিবারকে তাদের সন্তানদের উপার্জনমূলক কাজে জড়িত করে থাকে। ১৫ বছরের নিচে বিশ্বের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১৫০ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন পেশায় যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কর্মজীবী শিশুর বেশির ভাগই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সুযোগ পায় না।
জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে গ্রেট ব্রিটেনে কারখানা চালু হলে সর্বপ্রথম শিশুশ্রম একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে গৃহযুদ্ধের পর এবং দক্ষিণে ১৯১০ সালের পর শিশুশ্রম একটি স্বীকৃত সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। আগের দিনে শিশুরা কারখানায় শিক্ষানবিস অথবা পরিবারে চাকর হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু কারখানাগুলোতে তাদের নিয়োগ দ্রুতই প্রকৃত অর্থে হয়ে দাঁড়ায় দাসত্ব। ব্রিটেনে ১৮০২ সালে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে সংসদে গৃহীত আইনে এ সমস্যার নিরসন হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে একই ধরনের আইন অনুসরণ করা হয়। যদিও ১৯৪০ সাল নাগাদ বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশে শিশুশ্রম আইন প্রণীত হয়ে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে বহু শিশুকে আবার শ্রমবাজারে টেনে আনে।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও অভাব-অনটনের সংসারে একটি শিশুকে উপার্জনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। সংসারের প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাঁধেও সংসারের দায় বর্তায়। আর জীবনের শুরুতেই উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ শিশুদের শিশুত্বকে নষ্ট করে দেয়। ফলে তারা সেখান থেকেই ঝরে পড়ে। একটি কোমলমতি শিশুর জীবনের সকল স্বপ্ন-কল্পনার সেখানেই অপমৃত্যু ঘটে।
আমাদের দেশে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ঘরে, মাঠে এবং কারখানায় কাজ করতে দেখা যায়, যা অনেকটা বিনা বেতনেই বলা চলে। বেতন মিললেও তা অতি সামান্য। কেউ কেউ পেটে-ভাতেই সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। এখানে নানা সভা-সেমিনারে শিশু অধিকারের কথা বলা হলেও বিষয়টিতে প্রকৃত অর্থে সামান্যই গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশু অধিকারের অব্যাহত অপব্যবহার এবং লঙ্ঘন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং এ অবস্থায় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


শিশুরক্ষায় আইন আছে। তার সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের কোমলমতি শিশুদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে। এসো, আমরা শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই, পাশাপাশি আমাদের মতো কোনো শিশু যেন আমাদের দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখি। সম্ভব হলে তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসবো এই হোক আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার।

আগামীদিনের সুনাগরিক শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। নীতিহীন রাজনীতির এ নিষ্ঠুর হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্তি পাক শিশু, শিক্ষাঙ্গন এবং আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ- এবারে জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে এ হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।

You May Also Like

0 comments