স্বাধীনতার ৪৭ বার্ষিকীঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা

by - March 25, 2018

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং সেইসাথে বাংলাদেশের জন্মদিন আজ।

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতের পর এক ঐতিহাসিক ঘোষণপত্র জন্ম দিয়েছিল যে দেশটির, সে দেশ আজ পালন করছে নিজেদের ৪৭ তম জন্মবার্ষিকী।

স্বাধিনতা ঘোষণা হবার পর সবার আগে কর্তব্য ছিল দেশ থেকে শত্রু বিতাড়ণ। বাংলা মায়ের অদম্য ছেলেরা সে কাজটি করে গেছে অসীম সাহসিকতার সাথেই। আজ স্বাধীনতার এই ক্ষণে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ১৯৭১ এ শহীদ ও যুদ্ধাহত সকল দেশপ্রেমি জনতাকে।

বলা হয়ে থাকে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আর এটাই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কাজ।

শত্রু  মুক্তিই শুধু স্বাধীনতা নয়, বরং প্রকৃত স্বাধীনতা নিহিত থাকে দেশের গাঠনিক উন্নয়নে। একটি দেশ বিশ্বের সামনে কতটা উন্নত, সেটাই সেই দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা।

দেশ স্বাধীন হবার ৪৭ বছর পার করতে গিয়ে আমরা দেখি, এখনো গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতাণত্রিক শাসন, যার ফলে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের শীর্ষ ৫ এ জায়গা করে নিয়েছে। যে গণ মানুষের অধিকার রক্ষায় এই যুদ্ধ, তার প্রকৃত অর্থই আজ ভূলুন্ঠিত।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশ বেশকিছু দিকে অসাধারণত্য দেখিয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশকিছু অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে উন্নীত করেছে মর্যাদার আসনে। স্বল্প সম্পদ ও অধিক জনশক্তি নিয়ে যাত্রা করা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সত্যিই গর্ব করার মতই। 

অহংকার নিয়ে বলছিলাম। অহংকার ব্যাপারটা দুরকমের হয়। প্রথমত হল নিজেদের একটা মহান অর্জন নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা প্রফুল্লতা বজায় রাখা। আর দ্বিতীয়ত, নিজেদের অর্জন ও অন্যদের সেটা নেই বলে তাদেরকে খাটো করে নিজের মহানতা জাহির করা। প্রথম কাজট যখন হয়, তখন অন্যরাও আপনার অহংকারবোধকে স্বাগত জানাবে, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এটা নিচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেক কষ্টে  অধিকার আদায়ের ইতিহাস।  কষ্টে অর্জিত বলেই এই স্বাধীনতা আমাদের পরম আকাঙ্খিত। তাই এর সম্মানও আমাদের কাছে অনেক।

কিন্তু এই সম্মান বজায় রাখার জন্য বর্তমানে আমাদের অবদান কতটুকু? আমরা কি পারছি সেই দেশ প্রেম দেখাতে? আমরা কি পারছি আমাদের অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে? 

উত্তর সবারি জানা। দেশব্যপি অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি ও প্রহসনের যে তান্ডব চলছে, তাতে আমাদের ছাত্রসমাজ কতটা প্রতিবাদ দেখাতে পেরেছে? কোনকিছু হলেই আমরা অতীত ইতিহাস স্মরণ করতে পছন্দ করি। 
৫২ তে করেছি, ৬৬ তে করেছি, ৬৯ করেছি, ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ তে বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী আন্দোলন কিংবা ৯০ এ চুড়ান্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। সবই ছাত্রদের অবদান। 

কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা কী করেছি, সেটাও দেখার বিষয়। আমরা কি আমাদের সেই চেতনাবোধ ধরে রাখতে পেরেছি? পেরেছি কি আমাদের সার্বজনীন শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখতে? 

স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল মুখের ভাষার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা। সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ইতিহাস আমাদের আরো একটি গৌরবজ্জল অধ্যায়। 

তাই সেই ভাষার সম্মান রক্ষা করা আমাদের সবার মহান কর্তব্য। 
কিন্তু সম্মানের মানে এই নয় যে, আমরা নিজেদের ভাষা রেখে  সারাদিন ঐ ভাষা নিয়ে পড়ে থাকব। প্রতিদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা যে পরিমান বাংলাকে অবজ্ঞা দেখতে পাই, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে, তা লজ্জাকর। বিভিন্ন পার্টি, কন্সার্ট, উৎসব, বিভিন্ন ডে বা এসব নামে অহরহ অন্য ভাষার গান বাজানো হয়, যেখানে বাংলা হয়ে যায় সংখ্যালঘু। নাচের ক্ষেত্রেও দেখা যায় আমাদের আধুনিকমনা শিক্ষার্থীগণ বাংলাকে পাত্তা দিতে চান না। বলা হয় বাংলায় যথেষ্ট উপযোগী সংগীত নেই। কিন্তু আমরাই যদি সেগুলো ব্যবহার না করি তাহলে সমৃদ্ধতা আসবে কিভাবে?  অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই বাংলার সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার কথা ছিল।  

বিশ্ববিদ্যালয় এর কথা আসলেই সবার আগে চলে আসে উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার । আমার মনে হয় উচ্চ শিক্ষায় ভাষার ব্যবহার নিয়ে আময়াদের একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ। 

বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার সব বই ইংরেজিতে পড়তে হয় এবং শিক্ষার ভাষাও ইংরেজি। এমনকি উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করা হয় ইংরেজী ভাষায়। 

উচ্চ শিক্ষায় বাংলার প্রয়োগ ঘটাতে হলে আমাদের দুটো ব্যাপার সামনে চলে আসে। 
প্রথমত, বাংলাকে যদি উচ্চশিক্ষার ভাষা করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল এর জন্য প্রয়োজনীয় বই  ও অন্যান্য উপাত্তের সংকট। কেননা ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ায় এই ভাষায় পৃথিবীর সকল কিছু সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু যখন, আমরা বাংলা ভাষায় পান্ডীত্য অর্জন করতে যাব, তখন ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে হবে, ফলে আপনাকে ইংরেজি জান্তেই হচ্ছে। 

দ্বিতীয়ত, যখন আমরা বিদেশে যাই, তখন শুধুমাত্র বাংলায় উচ্চশিক্ষা আমাদের বিপাকে ফেলবে। কেননা তখন আপনি তাদের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারবেন না। যদিও এখনো আমাদেরকে বিদেশে যেতে আইএকটিএস বা টোফেল পরিক্ষা দিয়ে যেতে হয়, তবুও ইংরেজি জানা থাকায় আমরা সুবিধা পেয়ে থাকি। বাংলাই যদি একমাত্র ভাষা হত, তাহলে এই সুবিধা আমরা পেতাম না। 

অন্যদিকে, আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। চীন, কোরিয়াসহ আরো কিছু দেশ তাদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষাদান করে থাকে। কিন্তু এখানে ভালো ব্যাপার হল তাদের প্রতোজনীয় সকল বই নিজেদের ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের না। এছাড়াও ওসব দেশ স্বাবলম্বি। তাদের নিজেদের দেশেই নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে। বরং তারা বিদেশ থেকে মানুষ নিয়ে যায় কাজ করতে। এবং তাদেরকে তখন ঐ দেশের ভাষা জেনে সেখানে কাজ করতে যেতে হয়।  বাংলাদেশে যে সুযোগটা নেই ।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, ওসব দেশ কি একদিনে এমন হয়েছে ? উত্তর অবশ্যই না। এজন্য তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হয়েছে। অনেকদিন ধরে নিজেদের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে হয়েছে।তারপর তারা এরকম কাজ করতে পেরেছে। 

এখন অন্য একটি উদাহরণ দেই। জাপান একসময় ইংরে্জি বিদ্বেষী ছিলো। শুধুমাত্র নিজেদের ভাষা ব্যবহার করতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ইংরেজী ভাষী আমেরিকানদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে থাকে। তারাও নিজেদের ইংরেজী জ্ঞান বাড়াতে থাকে এবং নিজেদেরকে বিশ্বের সবার সাথে তাল মেলাতে থাকে। ফলে তারা দ্রুতই উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। আমেরিকার সাথে এতবড় যুদ্ধ সত্বেও জাপান বন্ধুত্বের হাত মিলিয়ে নিজেদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়েছে। এই স্বার্থ চেতনা বিরোধী নয়, বরং উন্নতির স্বার্থ। নিজেদের কিভাবে উন্নতি হবে, সেটা চিন্তা করে তাদের যা করণীয়, সবই করতে সক্ষম হয়েছে।  

দুটো উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, আমদের এ ব্যপারটা নিয়ে অনেক ভাবতে হবে। আমরা কি নিজেদের ভাষায় আলাদা তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করব, নাকি যাদের আছে, তাদেরটা ব্যবহার করে এগিয়ে যাব। 

আমার মনে হয় দ্বিতীয়টা শ্রেয়। কেননা ভাষা পরিবর্তনশীল। আজকে যা বাংলা আছে, একসময় এই বাংলা ছিলোনা। এরপরে এরকম থাকবেনা। তাই নতুন করে কিছু করে তা আকড়ে রাখার চেয়ে যা আছে, তাকে কিভাবে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা ভাবাটাই বেশী লাভজনক। 

এটা সত্য ইংরেজী বিদেশি ভাষা হওয়ায় তা শেখা কষ্টকর। কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যবসায়ীকে চিন্তা করতে হয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তার চিন্তা জুড়ে থাকবে পৃথীবীর কোথায় কি হচ্ছে, তা কিভাবে নিজের মধ্যে অর্জন করা যায়, তা কিভাবে কাজে লাগানো যায়, এসব।  তার মাথা হবে বিশ্বব্যপী। আর সেজন্য আন্তর্জাতিক ভাষাটাই উচ্চশিক্ষা হিসেবে যথেষ্ট যুক্তির দাবীর রাখে। 

এই প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা যদি বাংলায় শিখতাম, তাহলে কি সহজে শিখতে পারতাম না?? 
হয়ত শিখতে পারতাম, কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের উচ্চ শিক্ষায় ভাষার চেয়ে কি শিখছি সেটা বেশী গুরত্বপূর্ণ। ভাষা খুব একটা পার্থক্য করেনা। একটা অংক বাংলায় করলেও অংক, ইংরেজিতেও অংক। 

ভাষার মতো করে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের আরেকটা গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আমি হব ইঞ্জিনিয়ার, আমি কেন অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, আইন এসব শিখবো। ব্যাপারটা আসলে এইরকমই, আমি বাংলা ভাষী, আমি কেন ইংরেজী শিখবো।

এই কথা কেন বললাম, তার উত্তর দিচ্ছি। 
একজন ইঞ্জিনিয়ারকে হতে হয় সব জান্তা। ইঞ্জিনিয়ার যারা হবেন, তারা কি সবাই শুধু মেশিন বা অন্যান্য ব্যাপার নিয়েই পড়ে থাকবেন? নাকি শ্রমিক হবেন?

ইঞ্জিনিয়ারিং এর সংগা যদি খেয়াল করি, সেখানে একটা ব্যাপার থাকে, কোন একটা সমস্যাকে এমনভাবে সমাধান করা, যাতে তা সবচেয়ে সাশ্রয়ী হয় এবং সবচেয়ে বেশী মানুষ উপকারী হয়। মানুষের কি কি লাগবে, তা জানতে হলে আপনাকে চাহিদা সম্পর্কে জানতে হবে।

 একটা উপাদান মানুষের কাছে সহজে পৌছাতে, আপনাকে বাজার সম্পর্কে জানতে হবে। কতটা লাভজনক ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব এসব জানার জন্যেও অর্থনীতি আপনাকে সাহায্য করবে। পণ্য উৎপাদন ও এর নীতিমালা জানার জন্য আপনার আইন জানা জরুরি। সমাজবিজ্ঞান আপনাকে সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানাবে, যা আপনাকে সমাজের মানুষের সাথে নিজেকে মেলাতে সাহায্য করবে। 

এভাবেই প্রতিটি বিষয়ই আপনার জীবনের সাথে মিশে যাবে। আপনি যদি শুধু কঠিন কঠিন গণিত পড়েন, তাহলে আপনি হয়ে যাবেন রোবট, আবেগ অনুভুতি থাকবেনা। সেজন্য দরকার সাহিত্য। আমার মনে হয় মনোবিজ্ঞানও আমাদের পাঠ্য হওয়া উচিৎ। 

এক জায়গায় পড়েছিলাম, একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে একজন কবি। কবি যেমন ছন্দ দিয়ে কবিতা লেখে, তেমনি ইঞ্জিনিয়ারকে তার কাজের মধ্যে ছন্দ রাখতে হয়। তার মনে প্রেম থাকতে হয়। তাহলেই তার বানানো বাড়ির ডিজাইন হবে ছন্দময় । বানানো শহর হবে সাজানো। মেশিন হবে রোমান্টিক। তার কাজ হবে নির্ভুল। 

আর এই সাহিত্যের চেতনা কিন্তু আবার মাতৃভাষার সাথে জড়িত। যার ভাষার প্রতি বেশী শ্রদ্ধা, সে ভাল সাহিত্যিক। বলা হয়ে থাকে, ইঞ্জিনিয়ার ব্যর্থ হলে সাহিত্যিক হয়। কিন্তু আমি বলি প্রতিটা ভালো ইঞ্জিনিয়ারই একেকজন সাহিত্যিক ।  আর এই সাহিত্যের গুণ আসে মানবিকতা থেকে, আর যেটা আমাদের পাঠ্যসূচিতেই আছে।  

স্বাধীনতা মানে সবকিছুতেই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করুক সবাই। দেশের মানুষের অসুবিধা হয় এমন কাজ থেকে দূরে থাকুন।   আর ভালবাসুন মাকে। 

You May Also Like

0 comments