আমরা বেশী ইমোশনাল হয়ে পড়ছি

by - March 04, 2022

জাতী হিসেবে আমাদের ইমোশন বেশী সেটা জানা কথাই। 
কিন্তু জটিল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যখন যুক্তি ছাপিয়ে ইমোশনকেই আগে নিয়ে যাওয়া হয় সেটা আমাদের লুকিয়ে রাখা মূর্খ চরিত্রটাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। তার নিজের অজান্তেই তুলে ধরি আমরা কতটা নির্বোধ ও হিপোক্রেট! 

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে বাংলাদেশ কোনো ভোট দেয়নি।

বাংলাদেশ কোন বিবেচনায় ভোট দেয়নি, সেটা এখনো স্পষ্ট না। চীন, ভারত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, এঙ্গোলা, কাজাখস্থান, মালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক এদের মতো ৩৫টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ভোটদানে বিরত ছিল।

তবে আবার মানবিক দিক বিবেচনা করলে এটাকে অমানবিকও বলা যায়। কারণ এক দেশের মানুষের উপর ভিন্ন দেশ থেকে হামলা করা হয়েছে। এটাকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করার যুক্তি নেই। 
[এব্যাপারে সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের লেখা পড়তে পারেন ]

এটা যাইহোক না কেন, ব্যাপার হলো আজকে বিএনপি মহাসচিব সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এবং তিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এর উদাহরণ এনে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয়ার কথা বলেছেন। ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ইউক্রেনসহ যে কোনো দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের মৌলিক অধিকারকে শ্রদ্ধা করে এবং তার সীমা লঙ্ঘনকে বিরোধিতা করে।' [যুগান্তরের সংবাদ]

তো এই সংবাদের নিচের কমেন্টবক্সে বাংলাদেশের জনগণের মন্তব্যে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র।
সেখানে সবাই ফখরুলের বিরোধিতা আর সরকারের সিদ্ধান্তে সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কেউ বলছে দেশের ৯০-৯৫% মানুষ এই সিদ্ধান্তের পক্ষে।

এর বাইরে অন্য সংবাদ বা পোস্টের কমেন্টে দেখা যেতো মানুষ দেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত, তার ভোট দিতে চায়, তাদের অধিকার কেড়ে নেয়ায় চিন্তিত, তাহলে এখন কেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইউক্রেনের উপর একনায়ক পুতিনের হামলায় তারা বিশাল খুশি এবং দলে দলে পুতিনের ফ্যান ক্লাবে যোগ দিচ্ছে।

তো এখানে তাদের যুক্তি হলো-
১. প্যালেস্টাইন এর উপর হামলায় ইউক্রেন ইজরায়েলকে সমর্থন দিয়েছে।
২. আমেরিকা ইহুদী খ্রিষ্টান রাষ্ট্র এবং তারা এদের ধ্বংস চায়। যেহেতু পুতিন আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু করছে, তাই সে এখন হিরো।
৩. ইউক্রেন প্যালেস্টাইনের মানুষের উপর হামলায় কোনো প্রতিবাদ করেনি, এখন তারা বুঝুক নিজেদের উপর হামলা হলে কেমন লাগে! 

এ যুক্তিগুলো থেকে যদি আপনি রাশিয়ার আক্রমণ সাপোর্ট করেন, তা থেকে বোঝা যায় এটা আসলে প্রতিহিংসা ছাড়া কিছুই না। তুমি আমার ভাইয়ের উপর অত্যাচার করেছ, এখন তোমার উপর অত্যাচার হওয়া জায়েজ।

যদিও রাশিয়ার ইউক্রেনের উপর হামলার কারণের সাথে এর দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই! 
রাশিয়া এজন্য হামলা করছেনা না ইউক্রেন ইজরায়েলকে সাপোর্ট করে। 
এসব যুক্তি দিয়ে আপনি সর্বোচ্চ ট্রল করতে পারেন, মজা নিতে পারেন- দেখো এখন তোমাদের কেমন লাগে! 

যদি আপনি হামলার প্রকৃত কারণ জানেন এবং সেই যুক্তি বিবেচনা করে রাশিয়াকে সাপোর্ট দিতে চান, সেক্ষেত্রে হয়তো একটা বেজ থাকতে পারে যে রাশিয়া সিকিউরিটির কথা ভেবে হামলা করেছে।

কিন্তু এক্ষেত্রেও এটা কোনো যুক্তিসংগত কারণ হয়না।

ধরা যাক, চীন বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চালু করলো। ভারত সেটাতে যোগ দিবেনা। কিন্তু বাংলাদেশ যোগ দিতে চায়। এখন বাংলাদেশ যেন যোগ না দেয় সেজন্য ভারত বাংলাদেশের উপর হামলা শুরু করলো। এটা কি আপনার পছন্দ হবে? 

রাশিয়া যে কাজটা করছে সেটা হলো জোর করে আদায় করা। যেরকমভাবে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান জোর করে পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের মধ্যে রাখতে চেয়েছ।

ইউক্রেন একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানকার নাগরিকরা নিজেদের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছে। তারা নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইউক্রেনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি একজন ইহুদী। আর ইউক্রেন খ্রিস্টান রাষ্ট্র।

এদিকে রাশিয়াও খ্রিষ্টান রাষ্ট্র।
অর্থাৎ লড়াইটা দুইটা খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের মধ্যে।

সেখানে ধর্মের অন্ধ চশমা পরে এদেশবাসি ইউক্রেনের উপর প্রতিশোধ নিতে রাশিয়াকে মনের গোপন ভালোবাসা সব দিয়ে দিচ্ছে। 

অথচ চেচনিয়ার মুসলিমদের গণহত্যা, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সাথে মিলে রাসায়নিক ব্যবহার করে হত্যা এসবই রাশিয়ার কাজ। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে চীনে উইঘুর মুসলিদের উপর নির্যাতন হচ্ছে। এর বাইরে ইউরোপে ইসলামফোব ছড়ানোতেও রাশিয়ার অবদান কম না।

এদেশের মুখে মুখে গণতন্ত্রের স্লোগান তোলা প্রত্যেকের মনের ভেতরে আস্ত বড় একেকটা এক নায়ক বসবাস করে। 
এরা ভুলে যায় পুতিন হলো আরেকজন শেখ হাসিনা, কিম জং উন আরেকজন পুতিন।

বরং এই দ্বিমুখী নির্বোধ যুক্তিহীন কাজের কারণেই আমি দেখি এদেশের মানুষ কখনো নিজেদের যৌক্তিক সুবিধা আদায় করতে পারেনা, আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলিরা পারেনা শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে। 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পুরো ইউরোপ আর আমেরিকা যেভাবে দাঁড়াচ্ছে, সেভাবে মুসলিম সব দেশ বা ও আই সি একত্র হলেতো ইজরায়েলের অস্তিত্ব থাকার কথা না!

অথচ শুধু এই প্রতিহিংসা পরায়ণ আর নির্বোধ আচরণ এদের কূপমণ্ডূক করে রেখেছে।

এরা ভুলে যায় যে ইউক্রেনের মানুষগুলো আর প্যালেস্টাইনের মানুষগুলো একই। দুদলই অন্যায়ের স্বীকার।
প্যালেস্টাইন স্বীকার হচ্ছে, তাই ইউক্রেনের হওয়া জায়েজ এই চিন্তাটাই বিষাক্ত এবং শুধু প্রতিহিংসার।

এতে আর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এটাও ভাবা উচিৎ মায়ানমারে রোহিঙ্গা, ১৯৭১ এর বাংলাদেশী, প্যালেস্টিনিয়ান, সিরিয়া, সৌদিদের হামলায় গৃহহীন ইয়েমেন, চীনের উইঘুর আর ইউক্রেনের এখনকার মানুষ - সবাই একই শ্রেণীর। 

এদের কারো প্রতি সহমর্মি হতে গেলে সবার প্রতিই হতে হয়, নাহলে কারো জন্যই না!

নিজ দেশে মতামত প্রকাশ করতে না পারেন, তাই বলে শাসকশ্রেণীর অংশ হয়ে যাবেন না। 






You May Also Like

1 comments

  1. আমার মনে হয় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকার পিছনে একটা বড়ো স্বার্থ লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ এর।
    প্রথমত রাশিয়া আমাদের কে 1971 সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাপোর্ট করেছিলো। এইটা একটা কারণ হতে পারে।
    দ্বিতীয়ত আমরা কিছুদিন আগেই আমাদের দেশের নিরাপত্তার সার্থে রাশিয়া থেকে কিছু অ্যাটাক হেলিকপ্টার ক্রয় করার কথা জা এখনো প্রক্রিয়াধীন।
    এছাড়াও রাশিয়ার বিরোধিতা করলে রাশিয়া হয়তো সরাসরি আমাদের দেশের যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এ বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে তআ বন্ধ করে দিতে পারে।
    এখানে বাংলাদেশ কূটনৈতিক দিক থেকে সঠিক ভাবে এগুচ্ছে বলেই আমি মনে করি কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে অবশ্যই এটা একটি প্রশ্নে জর্জরিত বিষয়।
    এধরনের কতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ কখনোই শান্তি আনতে পারে না, জা পরে টা হলো ঘৃনা আর অশান্তি।

    এই ছোট ব্রেন এর ভুল ত্রুটি ক্ষমা র দৃষ্টিতে নিবেন ভাই।

    ReplyDelete