­
বিচার চাওয়ার পরিবর্তে ফাঁসির দাবীর ফল ভালো হয়নি, হয়না - Mahdi Hasan

বিচার চাওয়ার পরিবর্তে ফাঁসির দাবীর ফল ভালো হয়নি, হয়না

by - March 08, 2025

 


 

ধর্ষণ এর ঘটনা আলোচনায় আসলেই শাস্তি ফাঁসির দাবীতে অনেকে স্বোচ্চার হয়ে ওঠেন।

এটা নতুন কিছুনা, গত ১০ বছরের আমার দেখা সব আলোচিত ঘটনাতেই এই দাবী এসেছে।

তবে এবার সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফাঁসি চেয়ে মিছিল বের হয়েছে প্রথমবার- ঢাবি ও রাবিতে।

আইন পড়ানো হয়, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন এরকম দাবী নিয়ে রাস্তায় নামে, সেটা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানমানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

শুধু ধর্ষণ না, আরো অনেক অপরাধ আছে, যেখানে সবাই অপরাধীকে মেরে ফেলতে চায় সরাসরি। ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, এমনকি দুর্নীতিতেও।

১। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ এর ১ ও ২ উপধারায় ধর্ষণ চেষ্টা বা ধর্ষণ করলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা মৃত্যুদন্ডের কথা লেখা ছিলো। ২০২০ সালে তা সংশোধন করে "মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড" দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। এবং বিচার শেষ করার জন্য ১৮০ দিন বেঁধে দেয়া হয়। যদিও এরমধ্যে বিচার শেষ না করতে পারলে কী হবে, তা লেখা না থাকায় আইনজীবীরা নানা অজুহাতে মামলার সময় দীর্ঘায়িত করতে থাকে। আইনে কড়া শাস্তি থাকার পরেও কেন ধর্ষণ কমানো বা থামানো যায়নি, তা আমাদের ভাবতে হবে।


এখন বিবেচনায় আনতে হবে যে, শাস্তি শুধু শাস্তি হিসেবেই দেয়া হয়না। শাস্তি দেয়া হয় ভয় দেখানো ও শুধরানোর জন্য। যে শাস্তিতে নিজের ভুল বুঝে শুধরানোর অপশন থাকেনা, সেটা শাস্তি হয়না। এজন্য পরিকল্পিত খুনের বিপরীতেই শুধুমাত্র দীর্ঘ আইনী বিচার বিশ্লেষণ শেষে আরেকজনের প্রাণ নেয়া হয়। শুধু খুনের জন্যেই অনেকগুলো ধারা আছে, যেখানে পরিকল্পিত হত্যা(৩০২) ছাড়া বাকিগুলোতেও মৃত্যুদণ্ড নেই।

বাংলাদেশের মতো দেশে আইনী মানবশক্তি এত অপ্রতুল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যেতে হয় যে, এখানে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগের প্রসেসগুলোই যথেষ্ট শাস্তি দায়ী। এছাড়া থাকে ভুল বিচার, যেখানে শক্তিমত্তার প্রভাব থাকে।

এসব বিবেচনায় ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত হত্যা ছাড়া অন্যান্য অপরাধে জীবননাশ করা হয়না। ইউরোপ পুরোপুরিভাবে মৃত্যুদান থেকে সরে এসেছে এবং বাংলাদেশকে অনেকবার চাপ দিয়েছে সরতে। হাসিনা বিদায়ের পর মানবাধিকার কমিশনের প্রথম ভিজিটেও মৃত্যুদণ্ড বাদ দেয়ার জন্য আইনমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।

যদি আমরা ধর্ষণ বা হত্যাব্যতিত অন্য অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিই, তাহলে এটা অপরাধীকে সর্বোচ্চ অপরাধে উৎসাহিত করবে।

যদি ধর্ষণ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, এবং খুনের শাস্তিও এটা হয়, তাহলে সে ধর্ষণের পর ভিক্টিমকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবেনা। এক্ষেত্রে জোর করে ফাঁসির রায় দেয়াটা ভিক্টিমের জীবন বিপন্নের কারণ হতে পারে। 

যদিও টাঙ্গাইলেই ২০১৮ তে ৪ জন, ২০২০ এ ৫জন ও ২০২২ এ ৩ জনকে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর খুনের দায়ে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছিল। 

২। ২০১৯ এ সড়ক নিরাপত্তা আইন করার আগের মোটরযান আইনে দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত উভয় ক্ষেত্রেই ৩ বছরের জেল শাস্তি ছিলো। এতে অনেক ড্রাইভার দুর্ঘটনার পর আহত ব্যক্তিতে নিহতে পরিণত করতে চাইতো, কারণ আহত করা বা হত্যা, দুটার শাস্তি একই হচ্ছে। 

এজন্য নতুন আইনে নিহত হলে ৫, আহত হলে ৩ বছরের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

সড়কের এই উদাহরণ অনুযায়ী, ধর্ষণ অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এটা থামানো যাবেনা। বরং তখন ধর্ষণ গুলো খুনে পরিণত হবে। 


৩। বিচার বিভাগের উপর জনগণের ক্ষোভের খারাপ প্রভাবের একটা উদাহরণ হলো তারেক মাসুদ দুর্ঘটনা মামলা।

ততকালীন আইনে নিহত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর থাকলেও, চালককে যাবজ্জীবন জেল দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এটাকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করেছিলো।

কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এতে বাস চালকের কোনো দোষ ছিলো না। বরং তারেকের গাড়ি হঠাৎ লেন পরিবর্তন করে সামনে চলে আসে, এবং বাস চালকের চেষ্টায় ক্যাথরিন মাসুদ বেঁচে যায়।

কিন্তু মানুষের চাপের কারণে বাস চালক শাস্তি পায়, পরে জেলে মৃত্যুবরণ করে।

৪। গতবছর বুয়েটের মাসুদ নামে এক ছেলে ৩০০ ফিট এলাকায় দ্রুতগামী কারের ধাক্কায় মারা যায়। এই ঘটনায় সবাই সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানিয়ে বেশ কিছুদিন আন্দোলন চালায়। ফলে গাড়ির ভেতরে থাকা সবাই এখনো জেলেই আছে, নয়তো জামিন পেয়ে যেতো। 

সর্বোচ্চ শাস্তি দিলেও, তার ৫ বছরের জেল হবে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে আইন পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আনতে হবে, অথবা এটাকে পরিকল্পিত হত্যা হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। 

এখানে প্রব্লেম হলো, সড়কে যখন দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলো আপনি আইন বা শাস্তি দিয়ে আটকাতে পারবেন না। এরজন্য দরকার নানামুখী নিরাপত্তা - চালকের লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস, চালকের সুস্থতা। সব দুর্ঘটনায় যদি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, এবং পরিচিত কেউ নিহত হওয়ায় মানুষের আলোচনায় চলে আসে, তাহলে দেখা যাবে বিচারক ফাঁসির রায় দিয়ে দিবেন অন্যান্য ফ্যাক্ট বিবেচনায় না নিয়েই। এতে তারেক মাসুদ কেস ঘটার সুযোগ থাকবে। এখানে বুয়েটের মাসুদ ইস্যু যদিও আলাদা, সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উপর মাদকাসক্ত ড্রাইভার গাড়ি তুলে দেয়। ফলে তার বেশী শাস্তি হওয়া উচিৎ। তবে, কতটুকু হবে, সেটা নিয়ে আরো পর্যালোচনার দরকার আছে। মাদকের জন্য ৬ মাস, হত্যার জন্য ৫ বছর জেল, তার জন্য যথেষ্ট হবেনা। 

মূল আলোচনা হতে হবে, কিভাবে, কোন কোন ব্যবস্থা নিলে এই অপরাধগুলো কমানো যায়। শুধুমাত্র ঘাতকে শাস্তি দিয়েও যে খুব উপকার হচ্ছে, তাতো না। 

৫। ধর্ষণের ইস্যু সামনে আসলে, আমাদের আরো একটা চরিত্র সামনে আসে, তা হলো হারকিউলিস। ২০১৮ নির্বাচনের পর বেশকিছু আলোচিত ধর্ষণ ঘটনা সামনে আসে। তারপরেই ১৭ জানুয়ারী থেকে ১ ফেব্রুয়ারী এই দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনটি খুন হয়, যেগুলোর গলায় ঝোলানো পেপারে সে ধর্ষক ও এজন্য খুন হয়েছে - এমনটা লেখা থাকে। যদিও ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে বলে যারা দাবী করেছিলো, সেটা ডাক্তার প্রমাণ পায়নি। মোটামুটি অস্পষ্টতার মধ্যেই অভিযুক্তদেরকে মেরে ফেলা হয়। এবং শেষ দুজনকে কারা অপহরণ করেছে এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনুসন্ধানী একটি প্রতিবেদনে জানা যায় অপহরণে ব্যবহৃত গাড়ী ও টেকনোলজির সাথে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর ঢাকাস্থ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই হারকিউসের কাজ তখন জনগণ ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায়।

চলমান ইস্যুতেও অনেককে হারকিউলিসের জন্য আকাঙ্খা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কারণ, অজানা কারণেই এ অঞ্চলের মানুষজন সারাক্ষণ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। 

৬। সবাই যদি রাস্তায় নেমে গিয়ে বিচারের চেয়ে ফাঁসির দাবী বেশী জানায়, তাহলে সেটা বিচারকে প্রভাবিত করে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৩ গণজাগরণ মঞ্চ, ২০১৭ সালে তারেক মাসুদ দুর্ঘটনা মামলায়। 


তাই সরাসরি ফাঁসির দাবী নয়, অপরাধ কমানো ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল করে ৬০ বা ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার দাবী জানানো যেতে পারে। তাছাড়া এই ধরনের ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ করার জন্য ল্যাব ভিত্তিক প্রমাণ বেশী দরকার বিধায় যত দ্রুত করা যাবে, ততই সঠিক বিচার আসবে।

এক্ষেত্রে সরকার প্রভাবশালীদের ছাড় দেয়ার উদাহরনও আছে। জনরোষ থাকার পরেও বসুন্ধরা গ্রুপের আনভীরকে মুনিয়া হত্যা মামলার অভিযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়। সত্যতা আমরা বলতে পারবো না, কিন্তু এতে পরোক্ষভাবে যে আনভীর জড়িত আছে, সেটা ঘটনা প্রবাহ থেকেই বোঝা যায়। তবুও তাকে ছাড় দেয়াটা আইনের প্রতি উপহাস স্বরূপ। 

অন্যদিকে নারী নির্যাতন আইনে ৯০% ভুয়া মামলা হয় বলে প্রতিবেদন এসেছে, তাই এই ইস্যুটা সতর্কতার সাথে সামলাতে হবে।

এজন্য লোকবল বাড়ানো এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার বিকল্প নেই।

You May Also Like

0 comments