স্ব-বধ সমগ্র
বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন এর হিসাব মতে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের ৩৪০ জন এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ১০৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সে হিসেবে মাসে ৪৪ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেছেন।
২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন এবং ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন।
এবছরের প্রথম ৬ মাসে ২৩৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছর আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় একটি অংশ (২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ) এই পথ বেছে নিয়েছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মান-অভিমানের কারণে। ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন অভিমানের করে। এ ছাড়া প্রেমঘটিত কারণে ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এই তথ্য গুলোতে শুধু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ২০১৮ তে একবার দেখেছিলাম দিনে ২৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যান। ২০২২ এরকম বেশকিছু আত্মহত্যা আলোচনায় এসেছিলো। সেগুলো দেখে আমিও ভাবলাম, এরকম ঘটনাগুলোর একটা আলাদা সংগ্রহ রাখা যায়।
প্রতিটি মৃত্যুই অনেকগুলো ঘটনার প্রেক্ষিতে আসে, প্রত্যেকেরই আলাদা জীবন, আলাদা সমস্যা, কিন্তু সবার সমাধান একই জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে।
২০২২ এর সেই চিন্তার আলোকে ২০২৩ এর এপ্রিলে আমি এই তালিকার কাজ শুরু করি। এখানে অল্প কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এবং সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক। মূলত কিধরণের পরিস্থিতিতে তারা এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তা জানাই আমার এই প্রতিবেদন তৈরির মূল অনুপ্রেরণা।
অনেকগুলো ঘটনা বাদ পড়েছে, অনেকগুলোতে সব তথ্য উল্লেখ করতে পারিনি সময়মত না লিখতে পারায়।
১। মারিয়া রহমান
মার্চ ২৩, ২০২৩
বয়সঃ ২৫বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ৩য় বর্ষের ২য় সেমিস্টারের ছাত্রী ছিলেন মারিয়া। থাকতেন শেখ হাসিনা হলের ৭০৩ নম্বর কক্ষে।
ঠিকানাঃ নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা।
পিতাঃ ফয়েজ উদ্দিন
মৃত্যুঃ মার্চ ৩০, ২০২৩। ঢামেক আই সিউ তে থাকাকালীন।
Last Facebook Post:
I'm Maria Rahman,
17-07673 signing off, From the earth, being a student of Sher-e-Bangla Agricultural University
ঘটনাঃ শারীরিক অসুস্থতার কারণে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাধা দিয়েছিল। গত ২২ মার্চ তিনি একটি আবেদনপত্র নিয়ে শিক্ষকের কাছে যান। কিন্তু তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। এর জেরেই ২৩ মার্চ মারিয়া ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী হলের গার্ড পাভেল ভূঁইয়া বলেন, সকাল ৯টা ১০ মিনিটে হঠাৎ শব্দ শুনে গার্ড রুম থেকে বাইরে এসে দেখি এক ছাত্রী নিচে পড়ে আছে। লাফ দেওয়ার সময় কাঁঠাল গাছের ওপর পড়েছিল, ডাল ভেঙে নিয়ে নিচে পড়েছে। যতটুকু দেখেছি, হাত ভেঙে হাড় বের হয়ে গেছে।
সহপাঠীদের বক্তব্যঃ ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে মারিয়ার ক্লাসে উপস্থিতি ছিলো ৫০ শতাংশের কম। এ কারণে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছিলেন না। এছাড়া সে হতাশায় ভুগছিলেন। কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তার বেশ কয়েকটা সিটি পরীক্ষা বাকি ছিল। শুনেছি অনেক স্যাররা ওই পরীক্ষাগুলো নেবেন না বলেছেন। এছাড়া অসুস্থতার কারণে ক্লাস করতে পারেনি। গত ২২ মার্চ একটি আবেদন পত্র নিয়ে শিক্ষকের কাছে যান মারিয়া। কিন্তু তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। হলে বেড়াতে আসা তার মায়ের সঙ্গেও এ নিয়ে আক্ষেপ করেন মারিয়া, কান্নাকাটিও করেন। পরদিন ২৩ মার্চ সকাল ৯টার দিকে মাকে রুমে রেখে তিনি বের হন। এর কিছুক্ষণ পর হলের ছাদ থেকে মারিয়া লাফিয়ে নিচে পড়েন। ক্লাসে উপস্থিতির হার কম, ক্লাস-পরীক্ষা ও পারিবারিক চাপে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে বলে ’
তার ব্যাচের ক্লাস প্রতিনিধি আমান উল্লাহ বলেন, গতকাল ও (আহত শিক্ষার্থী) আমাকে ওর শিট ফটোকপি করার জন্য নিষেধ করেছিল। বিস্তারিত আমি কিছু জানতাম না, তবে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছিল।
এরপর গুরুতর আহত মারিয়াকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
অনুসিদ্ধান্তঃ দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে মানসিক চাপ কাজ করে। এই অবস্থায় পরিবারের সাথেও মনোমানলিন্য তৈরি হয়। আর পরিবারের সাথে সামান্য ঝামেলাও অনেক বড় প্রভাব ফেলে। শিক্ষকদের পরীক্ষা দিতে না দেয়া কখনো কাউকে সুইসাইডে প্রভাবিত করার কথা না। পারিবারিকভাবে সমস্যা থাকারা কারণেই স্যারদের কথাগুলো তার কাছে বেশী অপমানজনক হয়ে লেগেছে। সেকারণে স্ব-বধ।
২। আরাফাত রহমান সিয়াম
তারিখঃ ৩ বা ৪ এপ্রিল রাতের যেকোনো সময়।
বয়সঃ ২৫ বছর
অবস্থানঃ জাবি মীর মশাররফ হোসেন হলের বি-ব্লকের ১১৫ নাম্বার কক্ষে।
পরিচয়ঃ গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায়। জাবি-তে তিনি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন লেখকদের ইংরেজিতে লেখা মূল বই তিনি পড়তেন। ডিপার্টমেন্টে দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হলেও ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের সাথে শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। এছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়ের উপর বিশেষ পরীক্ষা দিতে হত। শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলেন সিয়াম।
কেউ কেউ বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত থাকার সুযোগ নেই। কারণ তিনি ইতোমধ্যে একটি অনলাইন চাকরিতে ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ কেন্দ্রের একাধিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘আরাফাত আমাদের কাছে কখনো চিকিৎসা নিতে এসেছে বলে জানা নেই।
ঘটনাঃ ৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ১৯ মিনিটে তিনি ফেসবুকে দীর্ঘ একটি পোস্ট দেন। যার শিরোনাম ছিল: অন দ্য ওয়ে টু ইটারনিটি (অন্তিম যাত্রার পথে)। যদিও তাঁর ওই পোস্টে সময় ৩ এপ্রিল ভোর রাত ৪টা ২৫ মিনিট লেখা ছিল। তার পোস্ট পড়া যাবে এই লিংকে ।
পরদিন এপ্রিল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করেন তাঁর সহপাঠীরা। পরে তাৎক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান তারা। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
মরদেহ উদ্ধারের সময় তাঁর পড়ার টেবিলে সাধগুরুর লেখা ‘ডেথঃ অ্যান ইনসাইড স্টোরি’ বইটি পাওয়া যায়।
সাধগুরুর মতবাদ হলো, জীবন অসীম। আর সেই জীবনে প্রবেশের বাঁধা হলো এই জীবন। তাই মৃত্যু যত আগে আসবে, সে তত দ্রুত অসীম জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। একইরকম চিত্র আমরা দেখেছি ভারতের বুরারি সুইসাইড ও বাংলাদেশের আদম ধর্ম অনুসারীদের সুইসাইডের ক্ষেত্রে। ধারণা করা হচ্ছে এই ছেলেটিও অসীম জীবনে প্রবেশের সিঁড়ি অতিক্রম করেছে।
৩। তানভীর ফুয়াদ রুমি
তারিখঃ ১৭ মে দুপুরে
বয়সঃ ২৪ বছর
অবস্থানঃ রুয়েটের লেফটেন্যান্ট সেলিম হলের ৩৫৫ নাম্বার রুমে।
পরিচয়ঃ বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৮ সিরিজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ঘটনাঃ একাডেমিক ফল নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ছিলো তার মধ্যে। সর্বশেষ একটি ল্যাব পরীক্ষায় কম মার্ক আসায় তা শিক্ষকে বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। শিক্ষক না করার পর নিজ রুমে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
অনুসিদ্ধান্তঃ রুমি লেখক সমাজে পরিচিত মুখ ছিলেন। তার প্রকাশিত বইও রয়েছে। স্বভাবে দৃঢ়চেতা রুমির আত্মহনন সবাইকে অবাক করেছে। বাইরে থেকে একজন মানুষ শক্তরুপে থাকলেও ভেতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে থাকতে পারে। তার সহপাঠী বা সমমনাদের বক্তব্য থেকে একাডমিক কারণ ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায়নি।
৪। রাকিবুল হোসেন রাফি
তারিখঃ ১৮ মে
বয়সঃ ২১ বছর
অবস্থানঃ হাজারীবাগের বাড্ডানগর লেন পানির ট্যাংকের পাশে একটি বাড়ির পঞ্চম তলায়।
পরিচয়ঃ রাফি বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার ছোট রাফি মা-বাবার সঙ্গে হাজারীবাগের ওই বাসায় থাকতেন।
ঘটনাঃ ৯৯৯ থেকে কল পেয়ে তার বাসায় গিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাফির কক্ষে পুলিশ একটি চিরকুট পায়, সেখানে ‘মা আমাকে মাফ করে দিও’ লেখা রয়েছে।
অনুসিদ্ধান্তঃ রাফি খুবই মেধাবী একজন মানুষ এবং টিউশনি করিয়ে অনেক টাকা আয় করতেন। তার বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তার একজন বান্ধবীও ছিলো, যাকে সে প্রায়ই দামী উপহার দিতো। হতে পারে বান্ধবীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে এ পথে পা দিয়েছিলো।
৫। জয়া কুন্ডু
তারিখঃ ১৯ আগস্ট
বয়সঃ ২৪ বছর
অবস্থানঃ ঢামেকের ডা. আলিম চৌধুরী ছাত্রীনিবাসের তৃতীয় তলার ৪৫ নম্বর রুমে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে ছিলেন। পরে সহপাঠীরা তাকে দেখতে পেয়ে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
পরিচয়ঃ জয়া কুন্ডু ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৭৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি খুলনা জেলার ফুলবাড়ী গেইট এলাকার কুয়েট রোডে। তার বাবার নাম তার বাবার নাম গিরিন্দ্রনাথ কু-ু। খুলনা ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও খুলনা বিএল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
একই সাথে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী জয়া কুন্ডু (২৪)। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হবার। তাই অন্য কোথাও চিন্তা না করে ২০১৮ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের নিকট জয়া ছিলেন অনুকরণীয়। তাকে অনুসরণ করেই অনেকে মেডিক্যাল কলেজে এসেছেন বলে জানা যায়।
তার সহপাঠি, কাজিনদের স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়- তুমুল হাসি, প্রাণবন্ত কথায় মাতিয়ে রাখতো সে। মেয়েটিকে অনেকেই অনুসরণ করতো, তাঁর ক্ষুরধারা মেধার কাছে নতজানু হতো। যে কিনা অনেকের পাশে থাকতো, হাসিমাখা মুখ নিয়ে সারাক্ষন মাতিয়ে রাখতো। অথচ তার ভেতরে কিনা বেদনার মহাসাগর! এই চাঁদমাখা মুখের আড়ালে, মেঘ লুকিয়ে থাকতো!
ঘটনাঃ বুধবার (১৬ আগস্ট) জয়া তার রুমমেট লাবনী রায় লাবুর মোবাইলে আই লাভ ইউ লাবু লিখে একটি মেসেজ পাঠান। একই সময় তার মাকেও একটি মেসেজ দেয় জয়া। ম্যাসেজ দেখে সন্দেহ হয় রুমমেট লাবনী রায় লাবুর। দ্রুত তিনি ছুটে যান ছাত্রী নিবাসের তৃতীয় তলার ৪৫ নম্বর রুমে। সেখানে গিয়ে দেখেন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে জয়া। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। সেখানে চিকিৎসকরা জয়াকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন জয়া।
জয়া কুন্ডুর বড় ভাই পার্থ কুন্ডু বলেন, আমি নিজেও আমি বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র। আমার বোন বেশ কিছুদিন যাবত ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে কাউন্সিলিংও করানো হয়েছিল।
বান্ধবী পৃথুলা রায় বলেন, আমি লাবনী ও জয়া কুন্ডু ডা. আলিম চৌধুরী হলের তৃতীয় তলার ৪৫ নম্বর রুমে থাকতাম। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২০১৮-২০১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী। গতকাল বুধবার সকালে লাবণী হল থেকে বের হয়ে যান। এরপর সকাল ১০টার দিকে জয়াকে রুমে রেখে আমিও বের হয়ে যাই। পরে জানতে পারি- জয়া আত্মহত্যা করেছে। জয়া অনেক দিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। কিন্তু কী কারণে ডিপ্রেশন, সে বিষয়টি আমরা জানতে পারিনি।
জয়া ডিপ্রেশনের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্নও হয়েছিলো। তার পরিবার এবং বন্ধুরাও তার প্রতি সাপোর্টিভ ছিলো। তবুও জয়াকে বাঁচানো যায়নি।
অনুসিদ্ধান্তঃ জয়ার সমস্যাটি একটি রোগ বলা যায়। সে ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিলো। যে কারণে তার মধ্যে সবসময় ডিপ্রেশন ভর করতো।
৬। ঋতু কর্মকার নিপা
তারিখঃ ১৯ আগস্ট
বয়সঃ ২৬ বছর
অবস্থানঃ ঢামেক ছাত্রী হলে সুইসাইডের ঘটনা ঘটে।
পরিচয়ঃ ঢাবির ২০১৫-১৬ সেশনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ঋতু কর্মকার নিপা, বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌর বাজারের নিপেন কর্মকারের মেয়ে। মাস্টার্স শেষে ঢাকার রসুলবাগের এক মেসে থেকে বিসিএস ও আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।
ঘটনাঃ শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সকালে ঋতু ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেয়েদের আবাসিক হলে তার এক বান্ধবীর কাছে যান। তবে সেই বান্ধবী, তখন হলে ছিলেন না। তখন ঋতুকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পান সেখানকার শিক্ষার্থীরা। তার কাছ থেকে জানতে পারেন, বিষপান করেছেন তিনি। তারাই তাকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে চিকিৎসক তাকে স্টোমাক ওয়াশ করানোর পর মেডিসিন বিভাগের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। ওই রাতেই তার অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার ১৯ আগস্ট দুপুরে তার মৃত্যু হয়। প্যারাকুয়েট জাতীয় অর্থাৎ ঘাসমারার বিষ পান করে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ঋতুর ছোট ভাই বিজয় কুমার কর্মকার জানান, এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না। তবে মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি ব্যবস্থা না হওয়ায়, মানসিক অবসাদের মধ্যে ছিল ঋতু ।
অনুসিদ্ধান্তঃ গ্রাজুয়েশন শেষ হলে সন্তানের প্রতি বাবা মার অনেক আশা থাকে চাকুরি করে সংসারের হাল ধরবে। ফলে এই সময় সন্তান বাড়তি চাপের মধ্যে থাকে। মেয়ে হলে সেই চাপটা কয়েকগুণ বেশী অনুভূত হয়। চাকুরি প্রত্যাশীরা দিনের পর দিন যখন পরীক্ষা দিয়েও কোথাও চাকরি নিতে পারে না, তখন তারা নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এজন্য দেখা যায় এডমিশন সময় এবং মাস্টার্সের পর শিক্ষার্থীরা আত্মহননের চেষ্টা বেশী করে থাকে। পারিবারি সাপোর্ট এসময় বেশী জরুরী হয়।
৭। শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম
তারিখঃ ২১ আগস্ট
বয়সঃ ২৫ বছর
অবস্থানঃ সোমবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৬৫ নম্বর কক্ষ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পরিচয়ঃ মঞ্জুরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তার ফুপু (বাবার চাচাতো বোন) মেহেরুন আক্তার বলেন, মঞ্জুরুলরা তিন ভাই এক বোন, বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ভাই গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশবিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে চাকরি খুঁজছে। মঞ্জুরুল হচ্ছেন তৃতীয়। ছোট ভাই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তাদের পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্রতার মধ্য দিয়েই তারা বড় হয়েছে।
ঘটনাঃ রুমমেট ইমান উদ্দিন জানান, তিনি সকাল ৯টায় রুম থেকে চলে যান। তখন মঞ্জুর ঘুমিয়ে ছিল। এরপর তিনি আর হলে আসেননি। বিকেল ৫টার দিকে তার রুমমেট ইমান উদ্দিন রুমে প্রবেশের জন্য ধাক্কা দিলে মঞ্জুরের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। আরেক রুমমেট মো. ফরহাদ বলেন, সকাল ৭ টায় লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে চলে যাই তারপর আর হলে আসিনি। কী কারণে আত্মহত্যা করেছে বলতে পারছি না। তবে মঞ্জু ভাই সব সময় চুপচাপ থাকতেন।
পার্শ্ববর্তী ১৬৭ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী হাম্মাদুর রহমান বলেন, ভাই কারো সঙ্গে তেমন মিশতেন না। প্রচুর অর্থ সংকটে ছিলেন। এমনিতে একাকী আর হতাশায় ভুগতেন। ভাই ইয়ার ড্রপ দিয়েছিলেন। তাদের রুম এই সময়ে ফাঁকা থাকে, সবাই লাইব্রেরিতে পড়তে যায়। আর এ সময়ই ঘটনা ঘটে।
মঞ্জুরুল দুই ইয়ার ড্রপ দিয়েছিল। বিভাগের এক ম্যামের সঙ্গে নিজের হতাশার কথা শেয়ার করেছিল। ম্যাম তাকে মনরোগ বিশেষজ্ঞও দেখিয়েছিলেন। সেই ডাক্তার তাকে কিছু মেডিসিন দিয়েছিলেন। তবে সে কয়েকদিন থেকে সেগুলো খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিল।
অনুসিদ্ধান্তঃ মঞ্জুরুল এর ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, তাকে অর্থনৈতিক সমস্যা গ্রাস করেছে। হতে পারে সে অর্থ আয় করার পেছনে ছুটতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, এতে ট্র্যাক থেকে সরে যায়। পরিবার থেকে কোনো চাপ ছিলো কিনা, তা জানা না গেলেও অনুমান করা যায় সেখান থেকে মানসিক সমর্থনের অভাব ছিলো। আর অন্য সব বিষয়ের চেয়েও পরিবার থেকে সমর্থন হারানোটা সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত করে আমাদেরকে। মঞ্জুরুলের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে।
0 comments