ট্যাক্সিডার্মি'র নাম শুনেছেন নিশ্চয়।
মৃত প্রাণীর চামড়া ব্যাবহার করে বিশেষ কৌশলে তার মধ্যে জীবন্ত রূপ ফুটিয়ে তোলাই হচ্ছে ট্যাক্সিডার্মি।
বিজ্ঞান ও শিল্পের এক স্বপ্নময় যুগলবন্দী হল ট্যাক্সিডার্মি।
বাংলাদেশের মানুষ এ ধরণের ব্যাপার সাধারণৎ হলিউডের সিনেমাতেই দেখে থাকে।
কেননা, শুধুমাত্র পৃথিবীর বিখ্যাত সব হিস্ট্রি মিউজিয়ামে( লন্ডন, বার্লিন, ওয়াশিংটন প্রভৃতি) প্রাণীদের এ ধরণের শিল্পময় উপস্থাপন দেখতে পাওয়া যায়।
এই কাজটা মোটেও সহজ নয়। দক্ষ ও নিপুণ ট্যাক্সিডার্মিস হতে গেলে ধৈর্য, একাগ্রতা ও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে সৃজনশীল শৈল্পিক মনের অধিকারী হতে হয়।
আর সম্প্রতি এই গুণগুলোর এক অসাধারণ অভিপ্রকাশ ঘটেছে দুই বাংলাদেশী আমিনুল ও রায়হান এর মধ্যে। ২০১৬ এর ৫-৯ এপ্রিল জার্মানির বার্লিন শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ট্যাক্সিডার্মি কনফারেন্স-২০১৬ উপলক্ষে বাংলাদেশের এই সাফল্যটি এসেছে। বাংলাদেশের দুই তরুণ আমিনুল ও রায়হান চারটি ক্যাটাগরিতে মোট পাঁচটি পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। তার মধ্যে আমিনুল একাই জিতেছেন দুটি প্রথম ও দুটি দ্বিতীয় পুরস্কার। রায়হান জিতেছেন একটি দ্বিতীয় পুরস্কার। আর এ অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেল দু'জন আন্তর্জাতিক মানের ট্যাক্সিডার্মিস্ট। ট্যাক্সিডার্মির জগতে বাংলাদেশও এখন অনন্য এক উচ্চতায়।
জার্মান ট্যাক্সিডার্মি সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০০ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিযোগিতার জন্য কয়েক মাস আগে আয়োজকরা প্রতিযোগিতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে কয়েকটি প্রাণীর প্রজাতি নির্ধারণ করে। বিশ্বের অন্যান্য প্রতিযোগীর মতো বাংলাদেশের রায়হান ও আমিনুলও সেই চ্যালেঞ্জিং প্রাণী প্রজাতির ট্যাক্সিডার্মি শুরু করেন এবং তাদের সেই তৈরিকৃত প্রাণীগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। দু'জনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করে বের হয়েছেন। ২০১৩ সাল থেকে জার্মানির অ্যাফোর্ট শহরে অবস্থিত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বিখ্যাত ট্যাক্সিডার্মিস্ট মার্কো ফিশারের তত্ত্বাবধানে ইউরোপের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানে ট্যাক্সিডার্মির বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন আমিনুল ও রায়হান।
এর আগে ২০১৪ সালে (২২-২৭ এপ্রিল) ইতালিতে অনুষ্ঠিত 'ইউরোপিয়ান ট্যাক্সিডার্মি চ্যাম্পিয়নশিপ' প্রতিযোগিতায় এই তরুণদ্বয় যুগ্মভাবে ইউরোপের সব প্রতিযোগীকে হারিয়ে দিয়ে 'বেস্ট ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড' শাখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
'ইউরোপিয়ান ট্যাক্সিডার্মি চ্যাম্পিয়নশিপ'_ এ ধরনের একটি প্রতিযোগিতা যা সাধারণত চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। এবারে এই প্রতিযোগিতা ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রোমানদের স্মৃতিবিজড়িত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্বাক্ষরবাহী লংগরন শহরে গত এপ্রিল মাসে (২২-২৭) অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপের পনেরোটি দেশ থেকে প্রায় ১০০ প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
বিশ্বে ১০০ বছর ধরে ট্যাক্সিডার্মির কাজ চললেও বাংলাদেশে তা মাত্র ৬-৭ বছর। আর এই অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দু'বার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করল।
বিশ্বে অনেকগুলো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম থাকলেও বাংলাদেশে একটিও নেই। তবে আশার কথা, ঢাকাতে একটি হিস্ট্রি মিউজিয়াম নির্মানের কাজ চলছে। এরপর প্রতিটি বিভাগেই একটি করে মিউজিয়াম করার পরিকল্পনা রয়েছে ।
বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে কিংবা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন প্রভৃতি কারণে নানা ধরনের অসংখ্য প্রাণী মারা যায়। ট্যাক্সিডার্মির সাহায্যে মৃত সেসব প্রাণীর অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে তা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। ট্যাক্সিডার্মিস্টরা হচ্ছেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অন্যতম মানবসম্পদ। তাই দু-দুটো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত আমিনুল ও রায়হান বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ একাধিক ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জন্যও সম্পদ হতে পারেন। বাংলাদেশ অপেক্ষায় রইল এই দুই তরুণের।
এডমিশন মৌসূমে ছেলেপেলেদের সবচেয়ে হতাশা দেখা যায় কোনো বিষয়ে পড়বে তা নিয়ে। লোকমুখে সিএসই, ইইই কিংবা বিবিএর নাম শুনে শুনে সবাই এগুলোকেও দামী হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হল, অন্য বিষয়গুলোর সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়না। যেকারণে উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান সহ অন্যান্য বিষয়গুলকে কেউ গুরত্ব দেয়ান। কারণ, এগুলো নিয়েও যে সৃজনশীলতা দিয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ কাজ করা যায়, তা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়না।
আমিনুল ও রায়হান ভাই এর প্রাণীবিজ্ঞান থেকে পড়ে পৃথিবীর নামিদামী পুরষ্কার অর্জন নিঃসন্দেহে জুনিয়রদের প্রাণিবিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ একটু হলেও বাড়াবে।
(দুবছর আগের লেখা থেকে...)
এ সম্পর্কিত আরো লেখাঃ