হিরোর কি সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে? নাকি সব মন গড়া আর আবেগের মিশেল।
ইতিহাস বলে সবকিছু আপেক্ষিক। বরং যে জয়ী হয়, ইতিহাস তাকেই বীর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, সে যেভাবেই জয়ী হোক না কেন!!
সিনেমায় সাধারণত দেখা যায় একজন খুব খারাপ লোক থাকে। সে সবসময় অত্যাচারী। আরেকজন খুব ভালো মানুষ। অন্যদের বিপদ থেকে রক্ষা করে। সে হয় নায়ক। নায়কের একজন নায়িকা থাকে। দূর থেকে দেখে কিংবা গল্পটাই। এমনভাবে বানানো যেন দর্শক দেখেই বুঝতে পারে কে হিরো। কিন্তু উল্টোভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, দুজনই কিন্তু নিজের কাজে উপযুক্ত যুক্তি নিয়ে আছে।
অথবা, যদি এমন হয়, দুজনই একটা কাজের আগ্রহী এবং দুজনরই পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু পাবে একজন। তখন আপনি কাকে হিরো আর কাকে ভিলেন বলবেন?
ইতিহাসে ফিরে যাই। প্রাচীন কাল থেকেই কিন্তু এমন দ্বন্দ্ব লেগে আছে। সেই আর্য-অনার্য দের যুদ্ধ থেকেই।
আমাদের পূর্বপুরুষ হল উপমহাদেশের অনার্য। তারা ছিল গুহাবাসী ও বিভিন্ন নদীর তীরে বসবাসকারী। আদিবাসীরা বিভিন্ন টোটেম বা গোষ্ঠিতে বিভক্ত ছিল। দৈত্য, রাক্ষস, পাখী, নাগ, অসুর এগুলা ছিল এখানকার আদিবাসীদের বিভিন গোষ্ঠী, শ্রেণী ইত্যাদিরই নাম।
বুঝতে অসুবিধা হয়না, অনার্যরা আর্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি ও সামনাসামনি মুক্তির লড়াই অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু জয় হয় শেষ পর্যন্ত আর্যদের। তাড়াতে তাড়াতে অনার্যদের নিয়ে যাওয়া হয় সুদূর শ্রীলংকা পর্যন্ত। সেখানেও লড়াই হয়। রাম-রাবনের যুদ্ধ তারই স্মৃতিবাহী।
কিন্তু আর্যদের এ জয় শুধু প্রভুত্বে নয়, ছিল শিল্প-সংস্কৃতিরও জয়। ফলে অনার্য রাক্ষস খোক্ষসরা আর মানুষ থাকলো না, হয়ে গেলো দানব, অসুর, দৈত্য ইত্যাদি। এই অঞ্চলের সমগ্র ভারতীয় আদিবাসীরা জন্তুতে পরিণত হল ইতিহাসে।
অথচ কি আশ্চর্য, আমরা আমাদের সন্তানদের রাক্ষস খোক্ষসের নেতিবাচক গল্প শোনাচ্ছি। আর এভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের কাছে ভীতির এবং ইয়ার্কির পাত্র হয়ে উঠেছে।
অথচ এ লড়াই ছিল সমান। হিরো হবার কথা ছিল অনার্যদের, যারা নিজেদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে লড়াই করেছে। জোরদখলদারদের রুখতে জীবন দিয়েছে। তাদের আমরা হিরোর স্বীকৃতি দেয়ার কথা। কিন্ত হিরো হয়ে গেলো দখলদার আর্যরা। ইতিহাস জয়ীদের পক্ষেই লেখা হয়।
ভারতীয় পর্বে আসি। ১৭৫৭ তে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে ইংরেজরা জয়ী হয়।
মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সেই যুদ্ধে জয়লাভ করে লর্ড ক্লাইভ।
এ যুদ্ধের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজ সাহিত্য ও অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশ এ প্রচলন ছিল জাফর একজন অনুগত বীরসেনা ও সিরাজ ভীতু, কাপুরুষ, পরাজিত দেশদ্রোহী নবাব হিসেবে!!
যদিও অনেক পরে উপমহাদেশের মানুষ প্রকৃত সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মীর জাফর প্রতারক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ শুধুমাত্র পরাজয়ের ফলেই ভিলেন পেয়েছিল বীরের মর্যাদা। ইতিহাস এমনি হয়।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। ৭১ এ যদি বাঙ্গালিরা পরাজিত হত, তাহলে বিশ্বদরবারে সেদিনের ইতিহাস অন্যরকম হত। এখন বাংলাদেশীরা যেভাবে পাঠ্যবই এ পাকিস্তানিদের দখলবাজ, অত্যাচারী হিসেবে জানছে, তখন সেটা হত বাংলাদেশীরা। মুক্তিযোদ্ধারা হত দেশোদ্রোহী, গাদ্দার, যেটা যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই শেখ মুজিব, পাকিস্তান আর্মিতে বিদ্রোহ করা জিয়া, ওসমানী, মতিয়ুররা পেয়েছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তান আর্মির সৈন্যরা হত দেশপ্রেমী অকুতোভয় সেনা। এদেশে যারা তাদের সহযোগীতা করেছে, তারা হত অনুগত বন্ধু। সব জায়গায় তাদের কৃতিত্ব থাকতো। অথচ দুদলের লক্ষ্য ছিল জয়। পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট বদলে দেয়। কে বীর আর কে ভিলেন তা পরিবর্তন হতে বেশীক্ষণ লাগেনা।
তাহলে বীর আর ভিলেন নির্ধারণের মানদণ্ড কি হবে? সিনেমায় ভালো আর খারাপ মানুষ দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। ইতিহাস পড়ে জানলাম যে জয়ী, তারা তাদের মতো ইতিহাস লেখে। প্রকৃত সত্য অধিকাংশ সময়েই আড়ালে থাকে। তাহলে আমি হিরো কাকে বলবো?
সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এ আসি।
দুজন ছেলেমেয়ে পরস্পরকে ভালোবাসে। পরিবার রাজি হলে সবকিছু ঠিক আছে। মেয়েটাও এই ছেলেকে ছাড়া কিছু বোঝেনা। একেবারে রিয়েল লাভ।
মেয়েটাকে আরেকটা ছেলে পছন্দ করে। সে মেয়ের পরিবারকে ম্যানেজ করে তাকে বিয়ে করে ফেলে। পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব না। তাই মেয়েটাও সবকিছু সহ্য করে নেয়। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারবেনা। পরের ছেলেটা সবই জানে। সে ইচ্ছা করেই এমন করেছে। সবকিছুই এখন তার।
সেও একদিন গল্প বলবে , আমি সবকিছু জয় করেছি। আরেকজন আমার কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তা হতে দিইনি।
হিরো কে হল?